কৃষি ভিত্তিক শিল্পের পরিবর্তন হবে?

Image

এবারের বাজেটে সরকার কৃষিভিত্তিক শিল্পে ১০ বছরের কর অব্যাহতি দিয়েছে। নতুন প্রণোদনা বিকাশমান এ শিল্পে বড় পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাজেটে আসলে সুনির্দিষ্ট কী কী সুবিধা দেওয়া হয়েছে, এর জন্য কোন কোন শর্ত পালন করতে হবে- এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে এ শিল্পের সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছেন মিরাজ শামস

দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রসার ঘটেছে। এর ধারাবাহিকতায় আধুনিক প্রযুক্তিতে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, দুগ্ধ শিল্প ও কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন অনেকটা এগিয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এসব খাতে ১০ বছরের করমুক্ত সুবিধা এবং নানা ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানিতে শুল্ক্ক রেয়াতি সুবিধা দিয়েছে। একই সঙ্গে তৈরি পণ্য আমদানিতে শুল্ক্ক বাড়ানো হয়েছে। এর উদ্দেশ্য কৃষিভিত্তিক শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। তবে এ খাতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও অন্যান্য নীতি সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমানে পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী কার্যক্রমের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। গবেষণার মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহিষুষ্ণ প্রযুক্তি ও ফসলের জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় চর অঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চল, খরা ও লবণাক্ততাপ্রবণ অঞ্চলে আউশ, আমন ও বোরো ধানের স্বল্পমেয়াদি জাতকে সম্পৃক্ত করে ১১ ধরনের শস্য বিন্যাস করা হচ্ছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, কৃষিভিত্তিক শিল্পের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিজাত পণ্যে আমদানি বিকল্প তৈরির মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ও কর্মসংস্থান সম্ভব হবে। মুক্ত বাণিজ্যের যুগে কৃষি পণ্যে মূল্য সংযোজন ও বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক রপ্তানি বাণিজ্যের দখল নেওয়া সম্ভব হবে। এসব দিক বিবেচনা করে বাজেটে নানা প্রণোদনার প্রস্তাব করেছেন তিনি।

বাজেটে যেসব উদ্যোগ: এবারের বাজেটে ফল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াজাত শিল্প, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন, শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী শিল্প এবং কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন শিল্পে শর্তসাপেক্ষে ১০ বছরের করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কৃষি, মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতে প্রশিক্ষণে ১০ বছরের কর অব্যাহতি দিয়েছে। এ ছাড়াও তাজা ফলের ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কৃষিযন্ত্র নিড়ানি ও ঝাড়াইকল উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। থ্রেসার মেশিন, পাওয়ার রিপার, পাওয়ার টিলার, অপারেটেড সিডার, কম্বাইন্ড হারভেস্টর, রোটারি টিলার, নিড়ানি ও ঝাড়াইকলের ওপর আমদানি পর্যায়ে আগাম কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কৃষির প্রধান উপকরণ সার, বীজ ও কীটনাশক আমদানিতে শূন্য শুল্ক্কসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান প্রধান খাদ্যদ্রব্যে শূন্য শুল্ক্কহার অব্যাহত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কৃষিপণ্যের সুরক্ষায় বিশেষ করে গাজর আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। মাশরুম আমদানিতে ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক্ক আরোপ করা হয়েছে। গাজর, মাশরুম, কাঁচামরিচ, শিল্প এবং গবাদি পশু খামারিদের সুরক্ষায় প্রক্রিয়াজাত মাংস আমদানিতে নতুন করে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এ খাতের উপকরণ, কাঁচামাল ও ওষুধ আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে স্টেইনলেস স্টিল আমদানিতে শুল্ক্ক প্রতি টনে ১৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে।

বঞ্চিত হবেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা :কর সুবিধা দিলেও এক কোটি টাকা বিনিয়োগের শর্তের কারণে তা নিতে পারবেন না অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনে প্রায় দুই হাজারের বেশি উদ্যোক্তা জাড়িত রয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ আছে অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের। ফলে বেশিরভাগ উদ্যোক্তা এ শর্ত মেনে সুবিধা নিতে পারবেন না। ফল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াজাত শিল্পেরও অনেকে শর্ত মেনে সুবিধা নিতে পারবেন না। দুগ্ধ ও দুগ্ধপণ্য উৎপাদনে জড়িত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাতেগোনা মাত্র কিছু প্রতিষ্ঠানের সুবিধা নেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। বেশিরভাগই এ খাতে নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এ জন্য এসব খাতের উদ্যোক্তারা শর্ত শিথিল করার দাবি জানিয়েছেন। তারা আরও বলেন, সহজ শর্তে কর এবং ঋণ সুবিধা দিলে এ খাতে বড় পরিবর্তন আসবে। স্থানীয় শিল্প এসব পণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।

উদ্যোক্তারা যা বলছেন :স্থানীয় শিল্পের বিকাশের অনেক সুযোগ রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কর সুবিধার পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য প্রস্তুতকার প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, কৃষি ও দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত শিল্পে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা ইতিবাচক। এসব খাতে দেশে শিল্প গড়ে উঠলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। নতুন বিনিয়োগে এ খাত আরও সমৃদ্ধ হবে। এতে বাজার প্রতিযোগিতা বাড়বে। পণ্যের মান উন্নয়ন হবে। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ হবে। সরকারের দেওয়া এ সুযোগ নিতে নতুন বিনিয়োগ অনেক বাড়বে। তিনি বলেন, এ খাত স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে আরও নীতি সহায়তা দরকার। স্থানীয় শিল্পের উন্নয়নে সরকারকে আরও নজর দিতে হবে। যেমন- পোশাক খাতে সুবিধা দেওয়ায় রপ্তানিতে ভালো করছে। পোলট্রি খাতে সুবিধা দেওয়ায় এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন শিল্পে তেমন অবকাঠামো উন্নয়ন, সহজ শর্তে ঋণ ও নীতি সহায়তা দিলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।

উদ্যোক্তাদের মতে, দেশে প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য প্রতিদিন দুধের চাহিদা সোয়া চার কোটি লিটার। এর অর্ধেকের কম উৎপাদন হচ্ছে। এ হিসাবে বছরে দেড় হাজার কোটি লিটারের বেশি দুধের প্রয়োজন। তাছাড়া বর্তমানে বছরে তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকার দুগ্ধপণ্য আমদানি হয়। এর মধ্যে গুঁড়াদুধ আমদানি হয় এক লাখ ৫০ হাজার টন। এই দুধ তরল আকারে হিসাব করলে বছরে প্রায় ১৮০ কোটি লিটার আমদানি হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পিতভাবে সুনির্দিষ্টভাবে উৎপাদন খাতে সুবিধা নিশ্চিত করলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

আকিজ ডেইরির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মোসলেহ উদ্দিন বলেন, খাদ্য, পোলট্র্রি, মাছ ও মাংস উৎপাদনে দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। কেবল পিছিয়ে আছে দুগ্ধ ও দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদনে। সরকার সুবিধা দেওয়ায় এ খাতও স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। তবে প্রকৃতপক্ষে যারা সুবিধা পাওয়ার কথা, তারা পেলে এ খাতের অনেক প্রসার হবে। এ সুবিধার অপব্যবহার রোধ করার পাশাপাশি শিল্পের উন্নয়নে নীতি-সহায়তা পেলে আমদানি নিরুৎসাহিত হবে। চাহিদার সবই দেশে উৎপাদন সম্ভব হবে এবং রপ্তানি করতে পারবে। সুযোগ দেওয়ায় আকিজ বিনিয়োগ বাড়াবে। আরও অনেকে বিনিয়োগে আসবে বলে তিনি মনে করেন।

কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ অলি উল্লাহ বলেন, সরকার ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এর সুবিধা নিতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানোর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সরকারের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী এ সুবিধা নিতে পারবে না বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। এই পণ্যের বাজার অনেক বড়। এ কারণে বিনিয়োগের সুযোগ অনেক বেশি রয়েছে। সরকার তিন হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে যন্ত্র দিয়েছে। এর বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়েছে। কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তিতে আবাদ করলে যন্ত্রের বাজার অনেক বড় হবে। এই শিল্পে ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের শর্ত দিয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সুযোগ পেলে ৫০ শতাংশের বেশি মূল্য সংযোজন করতে পারবে। এ জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দিতে হবে।

কৃষিপণ্য বিপণন :কীটনাশকমুক্ত শাকসবজির জোগান দিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে যাত্রা করেছে 'কৃষকের বাজার'। দেশে ৪১টি জেলায় কৃষকের বাজার স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কৃষকরা পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। রপ্তানি বাড়াতে শ্যামপুরে স্থাপিত ফাইটোস্যানেটারির মাধ্যমে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকার কৃষক অ্যাপের মাধ্যমে এবং ই-কমার্সে পণ্য বেচাকেনায় উদ্বুদ্ধ করছে। প্রথাগত মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সরকারের এসব উদ্যোগ সহায়ক হয়েছে বলে মনে করেন কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। তবে তারা পচনশীল ফল ও শাকসবজি উৎপাদক থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছতে হিমায়িত পরিবহন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন। এর ফলে উৎপাদতি এসব পণ্যের ৩০ শতাংশ নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। বিদেশের সুপারশপে জায়গা করে নিতে পারবে।

সরকারের পরিকল্পনা ও কৌশল :জাতীয় কৃষিনীতি অনুযায়ী, গবেষণা, কৃষি শিক্ষা, বিপণন ও সম্প্রসারণ সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত অংশীজনসহ কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের চাহিদাভিত্তিক গবেষণা মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের চেষ্টা চলছে। এতে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের চাহিদা মতো প্রযুক্তি ও তথ্যসেবার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত সহনশীল, পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ, টেকসই ও পুষ্টিসমৃদ্ধ লাভজনক ফসল উৎপাদন নিশ্চিত হবে।

সমৃদ্ধ কৃষির অগ্রযাত্রায় সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও এসডিজি বাস্তবায়ন শীর্ষক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে ছয়টি কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন, গুণগতমানসম্পন্ন কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, কৃষি সম্প্রসারণ, সেচ কাজে পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন চিহ্নিত করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী পোস্ট
ফ্লোরিডায় ভবন ধস: মৃত্যু বেড়ে ১৮, এখনও নিখোঁজ ১৪৭
পরবর্তী পোস্ট
চলছে কঠোর লকডাউন, রাস্তায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি কম

Related Posts